Latest News

দুষ্কর্মের দায় এড়ানোর কুশলী চর্চা!


রাজনীতিবিদেরা, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিরা মিথ্যা বলেন বা বলতে পারেন এমনটি বলা শোভনীয় নয় এবং সম্ভবত সংসদীয় আচরণবিধিতেও প্রতিপক্ষকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করা হয় না। বরং, কিছুটা কৌশলে বলা হয় যে তিনি অসত্য বলছেন বা যা বলছেন তা সত্য নয়। অর্থাৎ, সত্যের বিপরীতে যে শুধু মিথ্যা আছে তা নয়, অর্ধসত্য আছে এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণও আছে। অর্ধসত্য বলা বা সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে যাঁরা পটু, তাঁদের ক্ষেত্রে তাই ভদ্র ভাষায় বলা হয় যে তাঁরা সত্য বলায় কার্পণ্য করছেন। রাজনীতিকেরা সত্যের প্রশ্নে কতটা কৃপণ, তার প্রমাণ সব দেশেই অহরহ পাওয়া যায়। এই যেমন গণতন্ত্রের মডেল ব্রিটেনের একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে শুরু করি।


লন্ডনের কাছে থানে নামের একটি এলাকায় আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী কট্টর রাজনীতিক নাইজেল ফারাজ। প্রধানত অভিবাসনবিরোধী দল ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ রোববার তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কয়েক শ সমর্থক নিয়ে প্রচারাভিযানে নামেন। সেখানকার এক বিপণিকেন্দ্রে তাঁরা যখন প্রচারপত্র বিলি করছিলেন, তখন কয়েকজন ষন্ডাগোছের লোক সাধারণ লোকজনের মধ্যে যাঁরা ইউকিপের লিফলেট নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, তাঁদের হুমকি-ধমকি দেন। ফলে পুলিশের কাছে অভিযোগ যায় যে ইউকিপের কিছু পান্ডা গুন্ডামি করছে। বিষয়টি সম্পর্কে সাংবাদিকেরা ইউকিপের বক্তব্য জানতে চাইলে ইউকিপ মুখপাত্র দাবি করেন যে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে এই অপকর্মটি করেছে (ডেইলি মিরর, ২০ জানুয়ারি, ২০১৫)। ইউকিপের কর্মসূচির সময়ে সাধারণ মানুষ যে অপদস্থ হয়েছে, সেটুকু সত্য দলটির মুখপাত্র স্বীকার করে নিলেও খারাপ কাজটুকুর দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল অনুসরণে তাঁর একটুও সমস্যা হয়নি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হানাহানির নৃশংসতা এবং ব্যাপকতার তুলনায় ওপরের দৃষ্টান্তটি বলা চলে একেবারেই নগণ্য। কিন্তু রাজনীতিকদের দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল কিন্তু একই রকম। আগুনে বোমা কিংবা পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়ে মরছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু তার দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ। বিএনপি তার অবরোধ কর্মসূচির সময়ে বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী করেছে সরকারের এজেন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এগুলো হচ্ছে বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ছাত্রলীগের হানাহানিতে যখনই কারও প্রাণহানি ঘটেছে, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সন্ত্রাসীরা তাদের সংগঠনের কেউ নয়। এমনকি এ কথাও বলা হয়েছে যে ছাত্রলীগের সুনাম নষ্ট করতে তাদের সংগঠনে শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তারাই সব অপকর্মের হোতা। অঘটনপটীয়সীরা সত্য অস্বীকার করতে না পারলেও দায় এড়ানোর কৌশলটা রপ্ত করেছেন ভালোই।
রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালনে যে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই সত্য থেকে সবার দৃষ্টি এড়ানোর সহজ কৌশল হলো বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন ভুক্তভোগীর দায়িত্ব গ্রহণ। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে, সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ২০১৩ সালের নভেম্বরে দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা গীতা সেন এক বছর পর আক্ষেপ করে বলেছেন তাঁর কষ্ট ও চিকিৎসার খবর এখন আর কেউ নেয় না (প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি, ২০১৫)। টাকার অভাবে এখন তিনি দিনে চারবারের জায়গায় দুবার মলম লাগান। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন আহত ব্যক্তির চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ঘোষণা করে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু বাকিদের দায়িত্ব কে নেবেন? এসব সহিংসতার উৎস যে সংকট, সেটির রাজনৈতিক সমাধানের দায়িত্বই বা কার? অনেকে আশা করেন রাষ্ট্রপতির আসনের মর্যাদা হয়তো সবার ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। যাঁরা এমনটি আশা করেন, তাঁরা কিন্তু ভুলে গিয়েছেন যে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি একজনের সমাধিতে শ্রদ্ধা না জানানোয় কীভাবে পদচ্যুত হয়েছেন এবং দলীয় সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। আসল ক্ষমতা যাঁর হাতে, তিনি যদি রাজনীতির সংকটকেই স্বীকার না করেন, তাহলে এই অযাচিত ও দীর্ঘায়িত হতে থাকা দুর্ভোগের অবসান হবে কীভাবে? রাজনৈতিক সংকট এবং একে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা গণ্য করে পুলিশ এবং তার সহায়তায় বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনী মোতায়েনে যে এসবের সমাধান মিলবে না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুরুতেই বলেছি যে সত্য বলায় কার্পণ্য করা রাজনীতিকদের জন্য কঠিন কোনো অনুশীলন নয়। সে জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে যখন অবরোধ আহ্বানের জন্য খালেদা জিয়ার শাপশাপান্ত করা হয়, তখন তাঁরা ৪ ও ৫ জানুয়ারি অঘোষিত সরকারি অবরোধের কোনো কৈফিয়ত দেন না। একইভাবে খালেদা জিয়াও বাসায় ফেরার সুযোগ পেলেও রাজনৈতিক কারণে তা গ্রহণ না করে দপ্তরে অবরুদ্ধ থাকেন। সহিংসতার জন্য সরকারের এজেন্টদের দায়ী করার পাশাপাশি তিনি কি দয়া করে অবরোধকারীদের সহিংসতা পরিহারের নির্দেশনা দিতে পারেন না? যারা আগুনে বোমা ছুড়ছে, তারা যেহেতু তাঁর দাবি অনুযায়ী বিএনপির কেউ নয়, তাহলে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যও তো তিনি তাঁর সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানাতে পারতেন!
বিএনপি নেতাদের অনেকেই রাজনীতিতে জ্বালাও-পোড়াও সংস্কৃতি আমদানির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে থাকেন। তাঁরা বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সময়ে তৎকালীন শেরাটন হোটেলের সামনে আগুনে পুড়ে ১১ জন বাসযাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনার কথা বলেন। সেই ঘটনার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে জেরার মুখে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ সেলিম যে তাঁর দলের দুজন যুবনেতাকে (যাঁদের একজন সাবেক ও অন্যজন বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী) দায়ী করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই জিজ্ঞাসাবাদের রহস্যজনক অডিও এখন আবার ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে আবির্ভূত হচ্ছে। মামলাটি যে পরে রাজনৈতিক হয়রানির মামলা হিসেবে প্রত্যাহার হওয়ায় প্রমাণ করেছে যে রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত অপরাধের কোনো বিচার হয় না। চলমান অস্থিরতায় আগুনে বোমা ব্যবহারের সাফাই হিসেবে এসব কুদৃষ্টান্ত কূটতর্ককে দীর্ঘায়িত করতে পারে, কিন্তু নানা কারণে কলুষিত রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তা কোনোভাবেই সহায়ক হবে না। সুতরাং, সরকার কিংবা বিরোধী, ডান কিংবা বাম, আন্দোলনমুখী অথবা আপসমুখী সব রাজনীতিকেরই উচিত দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেওয়া যে তাঁরা কেউ আগুন লাগানোর রাজনীতি সমর্থন করেন না এবং এই অপরাধে যারাই জড়িত, তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়াই হবে একমাত্র দায়িত্বশীল কাজ। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতর আহত ব্যক্তিরা রাজনীতিকদের কাছে তেমন আকুতিই জানিয়েছেন (প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি, ২০১৫)। সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস যে কাউকে আশ্বস্ত করতে পারেনি, সেই হতাশার কথাও তাঁদের কথায় স্পষ্ট।
কথা উঠেছে অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে রাজনীতি আর রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিষয়টি হয়তো এখনো সে অবস্থায় পৌঁছায়নি। কিন্তু নানা ধরনের আলামতই এসব অশনিসংকেতের উৎস। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এসব বোমাবাজদের না চেনে, তাহলে তাদের পরিচয় কী? পুলিশের ভাষ্যমতে, সারা ঢাকায় ত্রাস ছড়ানোর পেছনে আছে জনা পঞ্চাশেক লোক। অভিযোগ (পরিবারের) সত্য হলে পুলিশ রাজনৈতিক কর্মীদের ধরে এনে ক্রসফায়ার ঘটাতে পারে, কিন্তু ওই ৫০ জনকে আটকাতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলোর প্রধানদের কাজ অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু আইনবহির্ভূত হুমকি প্রদানের পাশাপাশি তাঁরাও এখন ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের সাফাই গাওয়ার রাজনৈতিক দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
বিএনপিকে নিষিদ্ধ অথবা নির্মূল করার দাবি যাঁরা করছেন, তাঁদের আসল উদ্দেশ্যই বা কী? বিরোধী দলকে হয়তো নিষিদ্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বিরোধী শক্তিকে তো নির্মূল করা সম্ভব নয়। নবরূপে কোনো বিরোধী শক্তির উত্থান ঘটলে তা যে সুখকর হয় না, সে কথাটিও কারোর অজানা নয়। একজোটীয় শাসন যে কার্যত একদলীয় শাসনেরই আরেক চেহারা, সেটা তো কারও না বোঝার কথা নয়।
মহাজোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের অনুগত না থাকলে যেখানে দেশের তৃতীয় বড় দল জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিলীনের উপক্রম হয়, সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা জাসদের স্বতন্ত্র সত্তা টিকিয়ে রাখার বাস্তবতা যে আদৌ থাকবে না, সেটা নিশ্চয়ই কারও না বোঝার কথা নয়।
ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা প্রতিপক্ষকে নির্মূলের আশায় যে উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন বা উসকানি দিচ্ছেন, তার ফলটি তাঁরা ভেবে দেখছেন না। অথচ ক্রসফায়ার নাটকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় কি তাঁরা এড়াতে পারেন? রাজনৈতিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসের রূপ দেওয়া যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি রাজনৈতিক সংকটকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যার খোলস পরিয়ে বিনা বিচারে তা নিষ্পত্তির কৌশলও গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোর সবই চরম দুষ্কর্ম এবং নিষ্ঠুরতা।

No comments:

Post a Comment

হৃদয়ে বাংলা Designed by Templateism.com Copyright © 2014

Theme images by Bim. Powered by Blogger.